উপ-সম্পাদকীয় :
প্রতি বছর ৫ই জুন যখন বিশ্ব পরিবেশ দিবস আসে, তখন পরিবেশ সুরক্ষার অঙ্গীকার আর আলোচনা সভা-সেমিনার সর্বত্র দেখা যায়। আমরা গাছ লাগাই, প্লাস্টিক বর্জনের শপথ নিই, এবং দূষণমুক্ত পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি। কিন্তু এই অঙ্গীকারগুলো কি শুধু একটি নির্দিষ্ট দিনের আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ? পরিবেশের যে ভয়াবহ সংকট এখন আমাদের সামনে, তা থেকে মুক্তি পেতে হলে শুধু অঙ্গীকার যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন সেই অঙ্গীকারকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য আমাদের সবার সক্রিয় অংশগ্রহণ।
আজ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিশ্বজুড়ে স্পষ্ট। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, আকস্মিক বন্যা, দীর্ঘস্থায়ী খরা, ঘূর্ণিঝড়—এসবই আমাদের প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতার চরম পরিণতি। বায়ুদূষণ, নদীদূষণ, প্লাস্টিক দূষণের মতো সমস্যাগুলো আমাদের জীবনযাত্রাকে ক্রমশ কঠিন করে তুলছে। এসব সমস্যার মূলে রয়েছে মানুষের অপরিকল্পিত উন্নয়ন কার্যক্রম, নির্বিচারে প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস এবং পরিবেশগত অসচেতনতা। আমরা প্রায়শই মনে করি, পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব কেবল সরকারের বা পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর। কিন্তু এই ধারণা ভুল। পরিবেশ আমাদের সবার। তাই এর সুরক্ষার দায়িত্বও আমাদের প্রত্যেকের। যদি আমরা ব্যক্তিগতভাবে সচেতন না হই এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পরিবেশবান্ধব অভ্যাসগুলো গড়ে না তুলি, তাহলে যেকোনো বড় উদ্যোগই ব্যর্থ হতে পারে।
আমাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে কিছু জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে:
- দৈনন্দিন অভ্যাসে পরিবর্তন: প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো, অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনা থেকে বিরত থাকা, বিদ্যুৎ ও পানির অপচয় রোধ করা—এগুলো ছোট ছোট পরিবর্তন হলেও সম্মিলিতভাবে এর প্রভাব অনেক বড়। পুনঃব্যবহার (Reuse), পুনর্ব্যবহার (Recycle) এবং বর্জ্য কমানোর (Reduce) নীতি মেনে চলা উচিত।
- বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সচেতনতা: আমরা যেন যত্রতত্র বর্জ্য না ফেলি এবং নির্দিষ্ট স্থানে আবর্জনা ফেলার অভ্যাস গড়ে তুলি। নিজ নিজ এলাকায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নতিতে স্থানীয় প্রশাসনকে সহযোগিতা করা প্রয়োজন।
- গাছ লাগানো ও সংরক্ষণ: শুধু দিবস পালনের জন্য নয়, সারা বছরই গাছ লাগানোর অভ্যাস গড়ে তোলা এবং গাছ কাটা থেকে বিরত থাকা। একটি সুস্থ পরিবেশের জন্য বৃক্ষরোপণ অত্যন্ত জরুরি।
- সচেতনতা বৃদ্ধি: নিজেদের পাশাপাশি অন্যদেরও পরিবেশ সুরক্ষায় উৎসাহিত করা। পরিবার, বন্ধু-বান্ধব এবং কর্মক্ষেত্রে পরিবেশ বিষয়ক আলোচনা ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা যেতে পারে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিবেশ শিক্ষাকে আরও গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
- পরিবেশবান্ধব জীবনযাপন: ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারের পরিবর্তে গণপরিবহন বা সাইকেল ব্যবহার করা, নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস ব্যবহারে উৎসাহিত হওয়া—এসবই পরিবেশ সুরক্ষায় আমাদের সক্রিয় অংশগ্রহণের অংশ।
সরকারকে পরিবেশ সুরক্ষায় কঠোর আইন প্রয়োগের পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির প্রসারে আরও উদ্যোগী হতে হবে। শিল্প কারখানাগুলোকে পরিবেশগত মান বজায় রাখতে বাধ্য করতে হবে এবং সবুজ প্রকল্পগুলোকে উৎসাহিত করতে হবে। তবে, সরকারের একার পক্ষে এই বিশাল কাজটি করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
পরিবেশ রক্ষা কেবল একটি দিবস বা একটি স্লোগান নয়, এটি আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুস্থ ও সুন্দর পৃথিবী রেখে যেতে হলে, শুধু অঙ্গীকার করলেই হবে না, সেই অঙ্গীকারকে বাস্তবায়িত করতে হবে আমাদের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে। কারণ, পরিবেশ বাঁচলে আমরা বাঁচব।
এস.কে হেলাল,
কবি ও কলাম লেখক,
চাঁপাইনবাবগঞ্জ।