ইমন সরকার, ময়মনসিংহ জেলা প্রতিনিধি:
আজ সোমবার, ৮ ডিসেম্বর ময়মনসিংহের ভালুকার ইতিহাসের এক গৌরবময় দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে ত্রিমুখী আক্রমণে পাক হানাদার, রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর শক্তিশালী ক্যাম্প ভেঙে ছিন্নভিন্ন করে বিজয়ের পতাকা উড়িয়ে ছিল অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারা। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, অসংখ্য প্রাণের ত্যাগ আর শত্রুর বিরুদ্ধে অসীম সাহসিকতার পর ভালুকা অর্জন করে তার বহুল প্রত্যাশিত মুক্তি।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল। পাকিস্তানি শাসন ও নির্যাতনে ক্লান্ত জাতির স্বাধীনতার স্বপ্ন তখন দাউদাউ করে জ্বলছে। এমন সময় বৃটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সুবেদার আফসার উদ্দিন মাত্র একটি রাইফেল ও আটজন সঙ্গীকে নিয়ে মল্লিকবাড়ী বাজারে গোপনে গড়ে তোলেন মুক্তিবাহিনীর দল।
কয়েকদিনের মধ্যেই তারা সাহসী আক্রমণে ভালুকা থানা দখল করে ১৫–১৬টি রাইফেল, একটি এলএমজি ও বিপুল গোলাবারুদ উদ্ধার করেন। এর কয়েকদিনের মাথায় কাউরাইদ থেকে ক্ষীরু নদী দিয়ে ভালুকা থানায় আসার পথে পনাশাইল নামক স্থানে পাক বাহিনীর অস্ত্র ও গোলাবারুদ সহ একটি নৌকা মুক্তিযোদ্ধারা আটক করে প্রচুর অস্ত্রসস্ত্র উদ্ধার করে। যা ভালুকার মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তির ভিত্তি গড়ে দেয়।
পরে ভারতের মেঘালয় থেকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র হাতে ফিরে আসার পর এই ছোট দলটি ধীরে ধীরে শক্তিশালী বাহিনীতে রূপ নেয়। কিছুদিনের মধ্যেই ৮ সদস্যের দলটি সারে চার হাজারে উন্নীত হয়ে এফ জে ১১নং সেক্টরের ময়মনসিংহ সদর দক্ষিন ও ঢাকা সদর উত্তর সাব সেক্টর অধিনায়ক মেজর আফসার ব্যাটেলিয়ন নামে পরিচিত লাভ করে। এই বাহিনীর ত্যাগ-শৌর্যে ভালুকা পরিণত হয় মুক্তিযুদ্ধের একটি কৌশলগত যুদ্ধক্ষেত্রে।
১৯৭১ এর ২৫শে জুন শুক্রবার সকাল হতে পরদিন শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ভালুকা গফরগাঁও সড়কের ভাওয়ালিয়াবাজু নামক স্থানে আফসার বাহিনী পাক সেনাদের সঙ্গে মুখোমুখি হয় ভয়াবহ লড়াইয়ে। শিমুলিয়া নদীর তীরে টানা ৪৮ ঘণ্টা সংঘর্ষে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ পাকিস্তানি বাহিনীকে বিপর্যস্ত করে দেয়।
এ যুদ্ধের পর শত্রুপক্ষ ভালুকা ক্যাম্পকে ভয়ঙ্কর শক্তিশালী করে তোলে। একই সময়ে স্থানীয় মুসলিম লীগ নেতাদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে রাজাকার-আলবদরদের বিশাল ঘাঁটি। এসব রাজাকার আল বদররা ভালুকার বিভিন্ন গ্রামে দিনের পর দিন হত্যা, নারী ধর্ষণ, বাড়ী ঘরে আগুন ও লুটপাট চালিয়ে। ভালুকাকে অন্ধকারে তলিয়ে দেয়।
স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত আফসার বাহিনীর পরপর আক্রমণে পাক ক্যাম্প দুর্বল হতে থাকে। কিন্তু এই যুদ্ধে মেজর আফসারের নিজের ছেলে নাজিম উদ্দিনসহ ৪৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাৎ বরণ করেন। তাদের রক্ত মিশে যায় ভালুকার মাটিতে স্বাধীনতার শপথ হয়ে।
৭ ডিসেম্বরের রাত। চারদিক অন্ধকার, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের চোখে তখন স্বাধীনতার আলো। পরিকল্পিত ত্রিমুখী আক্রমণে মেজর আফসার বাহিনী ঘিরে ফেলে পাক সেনা ও রাজাকারদের প্রধান ক্যাম্প। ভোর হওয়ার আগেই শত্রুপক্ষ দিশেহারা হয়ে সড়ক পথে পালানোর চেষ্টা করে পাশ্ববর্তী গফরগাঁওয়ের দিকে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের অবরোধে তারা আর দূরে যেতে পারেনি। কেউ অস্ত্র ফেলে পালায়, কেউ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। পরে তাদের আটক করে ভালুকায় নিয়ে আসা হয়।
এভাবে ভালুকা হয় পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত। সেই থেকে যথাযোগ্য মর্যাদায় ৮ ডিসেম্বর’কে ভালুকা মুক্ত দিবস হিসেবে পালন করা হয়। দিবসটি উদযাপনে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বর্ণাঢ্য র্যালী এবং ভালুকা মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণের আয়োজন করা হয়েছে।

