আনোয়ার সাঈদ তিতু, কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি:-
কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলার থেতরাই ইউনিয়নের গোড়াইপিয়ারের চরে শত শত মানুষ তিস্তার তীব্র ভাঙ্গনের মুখে পড়েছেন। কয়েক দিনের ব্যবধানে শতাধিক ঘর-বাড়ি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বসতভিটে নদী গর্ভে হারিয়ে মাথা গোজারা ঠাঁই খুঁজে পাচ্ছেন না এসব ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ। বেশ কয়েক দিনের বৃষ্টি ও উজানের ঢলে তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় চরের নিম্নাঞ্চলগুলোতে বন্যার রূপ নিয়েছিলো। এখন নদীর পানি কমে যাওয়ায় ভাঙ্গন বৃদ্ধি পেয়েছে।
দিশেহারা হয়ে পড়েছেন উপজেলার তিস্তা নদী বেষ্টিত ১টি ইউনিয়নের চরাঞ্চলের তিস্তা পাড়ের মানুষ। নিরুপায় হয়ে অন্যের জায়গায় অনাহারে অর্ধহারে দিনাতিপাত করছেন ভাঙনে নি:স্ব হওয়া মানুষ। এই সময় তিস্তার চরে এত তীব্র ভাঙ্গন জীবনেও দেখেননি তিস্তার চরাঞ্চলের মানুষ। চর গোড়াইপিয়ারে গত কয়েক মাসের ব্যবধানে প্রায় শতাধিক বাড়ি ও ফসলি জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, নদী খননের কাজ না হওয়ায় প্রতি বছর এসব এলাকায় নদী ভাঙ্গন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং অনেক বসতভিটা বাড়িঘর নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। নিঃস্ব হচ্ছে শত শত পরিবার। তারা আরও বলেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে প্রতিবছর এরকম দুঃখ-দূর্দশায় পড়তে হবেনা চরাঞ্চলসহ তিস্তা পাড়ের মানুষকে।
এদিকে থেতরাই ইউনিয়নে তিস্তার ভাঙ্গনে হুমকির মুখে চর গোড়াইপিয়ার গ্রামের প্রায় ১ হাজার পরিবারের ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার মানুষ। হুমকির মুখে আছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৪টি, মসজিদ ৪টি ও নুরানি মাদ্রাসা ৪টি। এ চরাঞ্চলে হুমকির মুখে থাকা মানুষজন জানান, আমরা ত্রাণ চাইনা, আমরা চাই নদী সংস্কার। প্রতিদিন অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে, তাদের দুঃখ দূর্দশা দেখার যেন কেউ নেই। এর মধ্যে চর গোড়াইপিয়ার জামে মসজিদ দু’এক দিনের মধ্যেই নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে। ওই এলাকার তিস্তার চরাঞ্চলের মানুষের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
এছাড়াও উপজেলার বজরা, গুনাইগাছ ও দলদলিয়া ইউনিয়ন তিস্তা নদী দ্বারা বেষ্টিত। এসব ইউনিয়নের তিস্তা নদী ভাঙ্গন কবলিত এলাকাগুলোর মধ্যে পশ্চিম বজরা, বাঁধের মাথা, উত্তর সাদুয়া দামার হাট, খামার দামার হাট নদীর পশ্চিম পাড়, সাতালস্কর, চর বজরা, সন্তোষ অভিরাম, কাজিরচক, টিটমা, ঠুটাপাইকার, কর্পুরা, লাল মসজিদ ও অর্জুন এলাকা সহ বিভিন্ন এলাকা ভাঙ্গন কবলিত হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব এলাকায় ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, তিস্তার চরাঞ্চলের মানুষ নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন দিনের পর দিন। গত কয়েক দিনের ব্যাবধানে চর গোড়াইপিয়ারে তিস্তার ভাঙ্গনে সহশ্রাধিক বাড়ি ও একরময় একর আবাদি জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বন্যার পর তিস্তা পাড়ের মানুষ নতুন দুর্ভোগের শিকার নদী ভাঙ্গন। তিস্তা নদীর ভাঙ্গনে নদীগর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে বসতবাড়ি, আবাদি জমিসহ নানা স্থাপনা। প্রতিদিন কোনো না কোনো এলাকায় বসতভিটা, ঘর-বাড়ি তিস্তা নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। তারা উপায়ন্তর না পেয়ে অন্যের জমিতে ঘর উঠিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
এছাড়া হুমকির মুখে রয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয়, মসজিদ, শতশত বাড়িঘর ও একরময় একর আবাদি জমি। ভাঙন কবলিত এলাকার মানুষজন বসতবাড়ি রক্ষায় স্থায়ী প্রতিরোধের ব্যবস্থারও দাবি জানান। ভাঙ্গন কবলিত এলাকার মানুষ জানান, যে ভাবে নদী ভাঙ্গন শুরু হয়েছে তারাতারি ভাঙ্গন প্রতিরোধের ব্যবস্থা না নিলে এ চরাঞ্চলের প্রায় ১হাজার পরিবারের ৪ থেকে ৫ হাজার মানুষ অসহায় হয়ে যাবে।
এছাড়াও চর গোড়াইপিয়ার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রাম নিয়াসা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, জুয়ান সতরা চর গোড়াইপিয়ার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৪টি মসজিদ, ৪টি নূরানী মাদ্রাসা সহ উক্ত গ্রামের কয়েক হাজার লোক। তিস্তার ভাঙ্গনে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার লোকেরা বলেন, আমরা কোন সাহায্য চাইনা নদী সংস্কার চাই।
উপজেলার থেতরাই চর গোড়াইপিয়ার এলাকার দবিরর উদ্দিন (৬৭) বলেন, আমি চর গোড়াইপিয়ার জামে মসজিদের মোয়াজ্জিনসহ কৃষি কাজ করে জীবন যাপন করি। অনেক বছর আগে আমার বাড়ি ১৫ বার তিস্তা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। অনেক বছর হলো ভালোভাবেই বসবাস করে আসছি। হঠাৎ তিস্তার ভাঙ্গনে মসজিদসহ আমার বাড়ি নদী গর্ভে চলে যায়। এখন আমি অসহায় হয়ে পড়েছি বলে কেঁদে ফেলেন। এখন আমি অনাহারে অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছি। আজ কয়েকদিন হয়ে গেলো ঠিকভাবে পেটভরে খেতে পারছিনা।
বসত ভিটে বাড়ি ঘর নদী গর্ভে বিলীন হয়ে অন্যের বাড়িতে থাকা মজিবর রহমান (৫০), আইয়ুব আলী (৬৫), তৈয়ব আলী (৫২), মর্জিনা বেগম (৩২) ও সাজিনা বেগম (৪৬) সহ আরও অনেকে বলেন, তিস্তা নদীতে সহায় সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেলাম। শত শত একর জমি বাড়িভিটে সব নদীতে চলে গেছে। তিস্তা নদী আমাদের সব শেষ করে দিয়েছে। আমাদের চলার মত কিছুই থাকলো না। আমরা এখন অন্যের বাড়িতে পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছি। নদী ভাঙ্গন রোধে জোর দাবী জানান।
এছাড়াও চরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকার তিস্তার পাড়ে ভাঙ্গনের কবলে পড়া আব্দুল মজিত (৪৫), মহুবর মিয়া (৫৫), শফিকুল (৪৬), বাবলু (৬২), আছিয়া বেওয়া (৪৩) ও মোকছেদুল (৫৮) সহ আরও অনেকে জানান, তিস্তার ভাঙ্গনে আমরা নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছি। অনাহারে অর্ধাহারে দিনাপাত করছি। আমরা সাহায্য চাইনা আমরা চাই নদী সংস্কার। নদী ভাঙ্গন রোধের জোর দাবী জানাচ্ছি।
ভাঙ্গন কবলিত এলাকার স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থী আশা মনি (৬ষ্ঠ শ্রেণি), নাছরিন আক্তার (৩য় শ্রেণি) ও রবিউল ইসলাম (১ম শ্রেণি) সহ আরও অনেক শিক্ষার্থী বলেন, তিস্তা নদীর ভাঙ্গনে আমাদের পড়ালেখায় অনেক ক্ষতি হচ্ছে। আমরা স্কুলে যেতে পারছিনা। রাত্রে ঘুমাতে পারিনা। বাসায় পড়াশোনা করেতে পারিনা। তিস্তা নদী আমাদের স্বপ্ন গুলো ভেঙ্গে দিচ্ছে।
উপজেলার থেতরাই ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ড সদস্য আজিজার রহমান বলেন, তিস্তার চরাঞ্চলে তিস্তার ভাঙ্গনে শত শত একর আবাদি জমি ও বাড়িভিটে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এপর্যন্ত চর গোড়াইপিয়ার এলাকায় শতাধিক বাড়ি বিলীন হয়ে গেছে। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, নূরানী মাদ্রাসা ও মসজিদ হুমকির মুখে পড়েছে। নদী ভাঙ্গন রোধের জোর দাবী জানান তিনি।
উলিপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ( ইউএনও ) নয়ন কুমার সাহা চরাঞ্চলে যেসকল পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে তাদের আর্থিকসহ বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।