উপসম্পাদকীয় :
আর কতোটা উত্তপ্ত হলে আমাদের টনক নড়বে? কতোটা পুড়লে বুঝবো, এ এক নতুন বাস্তবতা? গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশের জনজীবন এক অসহনীয় তাপদাহে বিপর্যস্ত। বৈশাখের শুরু থেকেই সূর্যের অগ্নিমূর্তি দেখছে দেশবাসী, যা জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহেও অব্যাহত। রাজধানী থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যন্ত, ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবাই এই প্রখর তাপমাত্রার শিকার। এ যেন প্রকৃতির এক নীরব প্রতিশোধ, যা আমাদের অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং পরিবেশ বিধ্বংসী কার্যকলাপের ফল।
দিনের বেলায় রাস্তাঘাট প্রায় জনশূন্য। যারা নিতান্ত প্রয়োজনে বাইরে বের হচ্ছেন, তাদের চোখেমুখে স্পষ্ট ক্লান্তির ছাপ। শ্রমজীবী মানুষের দুর্দশা বর্ণনাতীত। রিকশাচালক, দিনমজুর, কৃষক—প্রত্যেকেই একরকম জীবন বাজি রেখে কাজ করছেন। একটু স্বস্তির জন্য হন্যে হয়ে খুঁজছেন ছায়া বা এক গ্লাস ঠান্ডা পানি। হিটস্ট্রোক, পানিশূন্যতা, ডায়রিয়াসহ নানা রকম রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে বাড়ছে রোগীর ভিড়। শিশুরা এবং বয়স্করা এই তাপদাহের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন। পরিস্থিত বিবেচনায় সরকার বিভিন্ন সময় স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা করেন। হয়তো যেকোন সময় বন্ধ করাও হতে পারে , কিন্তু জীবিকার তাগিদে তো আর সব বন্ধ করা যায় না।
এই তাপদাহ শুধু দৈনন্দিন জীবনকেই ব্যাহত করছে না, এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতেও। কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, বিদ্যুতের চাহিদা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় লোডশেডিংয়ের পরিমাণ বেড়েছে, যা শিল্প উৎপাদন এবং ব্যবসা-বাণিজ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে আসছে, কারণ বাড়তি খরচ হচ্ছে ঠাণ্ডা পানীয় এবং অন্যান্য জরুরি সামগ্রীতে।
আমরা কি শুধু প্রকৃতির উপর দোষ চাপিয়ে নিজেদের দায় এড়াতে পারি? নিশ্চয়ই না। নির্বিচারে গাছ কাটা, জলাভূমি ভরাট করা, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন এবং যানবাহনের কালো ধোঁয়া—এসবই কি এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী নয়? নগরায়নের নামে সবুজ ধ্বংস করে আমরা নিজেরাই নিজেদের বিপদ ডেকে আনছি। জলবায়ু পরিবর্তনের যে ভয়ঙ্কর প্রভাবের কথা বিজ্ঞানীরা বলছিলেন, তা আজ আমাদের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে।
এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনার পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনাও গ্রহণ করতে হবে। দ্রুত রাস্তার পাশে গাছ লাগানো, জলাধার সংরক্ষণ, নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি এবং পরিবেশবান্ধব শিল্পায়ন—এসব দিকে মনোযোগ দিতে হবে। সচেতনতা বাড়াতে হবে জনমানুষের মধ্যে। পানি অপচয় রোধ, বিদ্যুতের সাশ্রয়ী ব্যবহার এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে বৃক্ষরোপণের মতো ছোট ছোট উদ্যোগও সম্মিলিতভাবে বড় পরিবর্তন আনতে পারে।
এই তাপদাহ এক সতর্কবার্তা। প্রকৃতি আমাদের বারবার দেখাচ্ছে, আমরা যদি এর প্রতি যত্নবান না হই, তাহলে আমাদের অস্তিত্বই সংকটে পড়বে। এখনই সময়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী রেখে যাওয়ার অঙ্গীকার করার। এখনই সময়, নিজেদের ভুল শুধরে নিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানের পথে হাঁটার। অন্যথায়, এই প্রখর তাপদাহ হয়তো আমাদের জন্য আরও কঠিন পরিণতি নিয়ে আসবে।
এসকে হেলাল, কবি ও কলাম লেখক, চাঁপাইনবাবগঞ্জ।