রাঙামাটি সংবাদদাতা:-
জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশাল বনাঞ্চল ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। নদীতীরবর্তী এলাকা, বন এবং কৃষিজমি ধীরে ধীরে তামাকের দখলে চলে যাচ্ছে। তামাক চাষের ক্রমবর্ধমান চিত্র দেখলে সহজেই বোঝা যায়। এই অঞ্চলে তামাক চাষ যেভাবে অপ্রতিরোধ্য গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে তা কেবল একটি আঞ্চলিক সংকট নয়; এটি একটি ভয়াবহ জাতীয় বিপর্যয়ের পূর্বাভাস।
তামাক কোনও খাদ্য ফসল নয়, এটি কৃষি ফসলের শ্রেণীতেও পড়ে না। এটি কোনও প্রয়োজনীয় শিল্পের কাঁচামালও নয়। তামাক কেবল পাতা উৎপাদনের জন্য চাষ করা হয়। কারণ এতে নিকোটিন নামক একটি বিশেষ পদার্থ থাকে, এটি প্রকৃতির অন্যান্য পাতা থেকে আলাদা এবং এর একটি বিশেষ মূল্য রয়েছে, যা থেকে মূলত বিভিন্ন মানের এবং ব্র্যান্ডের সিগারেট এবং বিড়ি তৈরি করা হয়। এছাড়াও, জর্দা এবং গুল তৈরির অন্যতম প্রধান উপকরণ হল তামাক পাতা।
তামাক থেকে স্বল্পমেয়াদী মুনাফার তাগিদে কৃষকরা স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকিতে পড়ছেন, পরিবেশ দূষণ, নদী দূষণ হচ্ছে এবং তামাক চাষ জমির উর্বরতা ধ্বংস করছে, অন্যদিকে খাদ্যশস্য উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে, যা ভবিষ্যতে খাদ্য সংকটের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
রাঙ্গামাটি কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে রাঙ্গামাটি জেলায় ৪২৭ একর জমিতে তামাক চাষ করা হয়েছিল। এর মধ্যে জেলার বরকলে ১২৩.৪৬ একর জমিতে তামাক চাষ করেছেন ২২২ জন কৃষক। লংগদু উপজেলায় ১৬২.৭০ একর জমিতে তামাক চাষ করেছেন ১৩৫ জন কৃষক, বাঘাইছড়ি উপজেলায় ১৩৩.৪৩ একর জমিতে তামাক চাষ করেছেন ১২১ জন কৃষক এবং জুরাছড়ি উপজেলায় ৭.৪১ একর জমিতে তামাক চাষ করেছেন ২৩ জন কৃষক।
তবে রাঙ্গামাটি জেলায় তামাক চাষের পরিমাণ আরও বেশি। জেলায় নদীর উভয় তীরে প্রায় ৫০০ হেক্টর পলিমাটি আচ্ছাদিত জমিতে তামাক চাষ করা হয়।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং বাসযোগ্য পরিবেশ বজায় রাখতে তামাকের মতো আক্রমণাত্মক ও ক্ষতিকারক ফসলের বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করা এখন সময়ের দাবি।
রাঙ্গামাটি কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, রাঙ্গামাটিতে তামাক চাষের একটি উল্লেখযোগ্য বিকল্প হতে পারে পেঁয়াজ চাষ। তামাকের লাভজনক বিকল্প হিসেবে পেঁয়াজ চাষকে উৎসাহিত করা হচ্ছে, যা কৃষকদের জন্য একটি সম্ভাবনাময় ফসল হতে পারে। তামাক চাষকে নিরুৎসাহিত করতে এবং তামাকের পরিবর্তে পেঁয়াজ চাষ করার জন্য কৃষি কর্মকর্তারা মাঠে কাজ করছেন। কৃষকরা যদি তামাকের বিকল্প ফসল চাষে আগ্রহী হতে পারেন, তাহলে রাঙ্গামাটিতে তামাকের আক্রমণ অনেকাংশে কমে যাবে।
পার্বত্য অঞ্চলে তামাক পাতার চাষের সবচেয়ে বৃহৎ ক্রেতা হল বিএটি। এসব তামাক বাজারজাতকারী কোম্পানিগুলো চাষিদের তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ করছে। তামাক কোম্পানিগুলোর প্রলোভন, আগাম টাকা, কৃষি উপকরণ এবং নিয়মিত ‘সাপোর্ট’ কৃষকদের উৎসাহিত করছে লাভের ফাঁদে পা দিতে। যে কারণে খাদ্যজাতীয় ফসল বাদ দিয়ে কৃষকরা তামাক চাষের দিকে ঝুঁকছে।
তামাক চাষের কারণে রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে কাঁচা তামাক পাতা থেকে ‘সবুজ তামাক অসুস্থতা’ গোষ্ঠীর বিভিন্ন রোগ দেখা দিচ্ছে। দুর্বলতা, মাথাব্যথা, পেটব্যথা, বিভিন্ন ধরণের চর্মরোগ, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন এবং শ্বাসকষ্টের সমস্যা এর মধ্যে রয়েছে। এখানেই থেমে নেই, অনেকে এমনকি মারাত্মক ক্যান্সারেও আক্রান্ত হচ্ছেন।
তামাক চাষের কারণে বার্ষিক বন উজাড়ের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় স্থানে রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ে পুরাতন গাছের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পেয়েছে। বিশেষ করে বনজ, ফলজ এবং ঔষধি গাছ প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে।
তামাক চাষ কেবল জমির ঊর্বরতা ধ্বংস করছে না, বরং বাংলাদেশকে খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড় ধরনের সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার ও নাগরিক সমাজের সম্মিলিত উদ্যোগে তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ ও পর্যায়ক্রমে বন্ধ করা জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।