উপ সম্পাদকীয় :
করোনা ভাইরাস বিশ্বজুড়ে আমাদের জীবনযাত্রায় এক বিরুপ প্রভাব বিস্তার করেছে। যা অনেক পারিপার্শ্বিক পরিবর্তন এনেছে। সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) জানিয়েছে, বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ আবার বাড়তে শুরু করেছে, বিশেষ করে পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে। NB.1.8.1-এর মতো নতুন ভ্যারিয়েন্ট দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, এবং এর উপসর্গগুলো আগের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন হলেও, এটি সংক্রমণের হার বাড়াচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় কী, তা নিয়ে পুনরায় ভাবার সময় এসেছে। সংক্রমণের বর্তমান চিত্র ও নতুন ভ্যারিয়েন্টের উপসর্গ ২০২৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে এসে কোভিড-১৯ টেস্ট পজিটিভিটি রেট ১১ শতাংশে পৌঁছেছে, যা জুলাই ২০২৪ এর পর সর্বোচ্চ। যদিও আফ্রিকান, ইউরোপীয় এবং আমেরিকান অঞ্চলে সংক্রমণের হার তুলনামূলকভাবে কম, তবুও বিশ্বজুড়ে সতর্কতা জরুরি। বিশেষ করে থাইল্যান্ড, মালদ্বীপ, কম্বোডিয়া, চীন, হংকং এসএআর এবং সিঙ্গাপুরে সংক্রমণ বাড়ছে।
নতুন ভ্যারিয়েন্ট NB.1.8.1 বর্তমানে বিশ্বজুড়ে প্রায় ১০.৭ শতাংশ সংক্রমণের জন্য দায়ী, যা চার সপ্তাহ আগে ছিল ২.৫ শতাংশ। প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, এটি গুরুতর অসুস্থতার কারণ না হলেও, এর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা উদ্বেগের কারণ। নতুন ভ্যারিয়েন্টের উপসর্গগুলো অনেকটা সাধারণ সর্দি-কাশি বা ফ্লুর মতো। এর মধ্যে রয়েছে: হালকা জ্বর বা ঠাণ্ডা লাগা, গলা ব্যথা, নাক বন্ধ বা নাক দিয়ে পানি পড়া, শুষ্ক কাশি, ক্লান্তি, হালকা মাথাব্যথা এবং কিছু ক্ষেত্রে পেটের সমস্যা যেমন বমি বমি ভাব বা ডায়রিয়া। আগে স্বাদ বা গন্ধ চলে যাওয়া একটি সাধারণ উপসর্গ হলেও, এখন তা অনেক কম দেখা যাচ্ছে। উপসর্গগুলো হালকা হওয়ায় অনেকে আক্রান্ত হলেও তা জানতে পারছেন না, ফলে অজান্তেই রোগ ছড়াচ্ছে।
কোভিড-১৯ এর সর্বশেষ অবস্থা : বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট-
বিশ্বজুড়ে সংক্রমণের পাশাপাশি , বাংলাদেশেও এর প্রভাব দেখা যাচ্ছে। ১০ জুন ২০২৫-এর তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় ১০১ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ১৩ জনের শরীরে করোনাভাইরাস পাওয়া গেছে। এর আগের দিন (৯ জুন) ৪১ জনের নমুনা পরীক্ষায় ৫ জনের শরীরে ভাইরাস শনাক্ত হয়েছিল। বর্তমানে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ২০ লাখ ৫১ হাজার ৭৬০ জন। আশার কথা হলো, গত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত কারও মৃত্যু হয়নি। মোট সুস্থ হয়েছেন ২০ লাখ ১৯ হাজার ৩৭৮ জন। এই মুহূর্তে, নতুন আক্রান্তরা বেশিরভাগই ঢাকা মহানগরী এলাকার বাসিন্দা। ওমিক্রন LF.7, XFG, JN.1, এবং NB.1.8.1-এর মতো নতুন উপ-ধরন ভারতসহ বেশ কিছু প্রতিবেশী দেশে শনাক্ত হয়েছে, এবং বাংলাদেশেও এর সংক্রমণ রোধে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। NB.1.8.1 ভ্যারিয়েন্টটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আমাদের করণীয়ঃ
সংক্রমণ বৃদ্ধির এই পরিস্থিতিতে আমাদের কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি:
১. টিকা গ্রহণ: কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে টিকা গ্রহণ অপরিহার্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং সিডিসি (Centers for Disease Control and Prevention) ৬ মাস বা তার বেশি বয়সী সকল ব্যক্তিকে ২০২৪-২০২৫ সালের জন্য হালনাগাদ করা কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে। বিশেষ করে ৬৫ বছরের বেশি বয়সী এবং যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল, তাদের জন্য এটি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যারা আগে টিকা নিয়েছেন বা কোভিড-১৯ থেকে সেরে উঠেছেন, তাদের জন্যও পুনরায় টিকা নেওয়া জরুরি, কারণ সময়ের সাথে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।
২. স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা: সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা সংক্রমণ প্রতিরোধের অন্যতম কার্যকর উপায়। নিয়মিত সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধোয়া বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করা, হাঁচি-কাশির সময় মুখ ও নাক ঢেকে রাখা এবং অসুস্থ বোধ করলে বাসায় অবস্থান করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৩. মাস্কের ব্যবহার ও সামাজিক দূরত্ব: যদি আপনার এলাকায় সংক্রমণের হার বেশি থাকে অথবা আপনি ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে থাকেন, তবে মাস্ক পরা এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা উচিত। বিশেষ করে জনবহুল স্থান যেমন বাজার, শপিং মল, গণপরিবহন এবং যেকোনো ধরনের জনসমাগমে মাস্কের ব্যবহার সংক্রমণের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করবে।
৪. বায়ু চলাচল নিশ্চিত করা: ইনডোর পরিবেশে বায়ু চলাচল (ventilation) উন্নত করা ভাইরাসের সংক্রমণ কমাতে সহায়ক। জানালা খোলা রাখা বা ভেন্টিলেশন সিস্টেম ব্যবহার করা যেতে পারে।
৫. পরীক্ষা ও চিকিৎসা: যদি আপনার কোভিড-১৯ এর কোনো উপসর্গ দেখা দেয়, তবে দ্রুত পরীক্ষা করানো উচিত। র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট (RAT) বা আরটি-পিসিআর টেস্টের মাধ্যমে সংক্রমণ নিশ্চিত করা যায়। পরীক্ষায় পজিটিভ এলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। বিশেষ করে যারা উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে আছেন (যেমন বয়স্ক, দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত, গর্ভবতী নারী, ছোট শিশু), তাদের ক্ষেত্রে দ্রুত চিকিৎসা গ্রহণ গুরুতর অসুস্থতা থেকে রক্ষা করতে পারে।
৬. গুজব ও বিভ্রান্তি এড়ানো: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক সময় ভুল তথ্য ছড়িয়ে পড়ে। নির্ভরযোগ্য সূত্র, যেমন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, সরকারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বা প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান থেকে তথ্য গ্রহণ করা উচিত।
কোভিড-১৯ এখনো আমাদের সঙ্গ ছেড়ে যায়নি। এর প্রাদুর্ভাব আবারও বাড়া আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, ভাইরাসটির সঙ্গে সহাবস্থানের জন্য আমাদের সতর্ক ও দায়িত্বশীল হতে হবে। ব্যক্তিগত সচেতনতা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং সঠিক সময়ে টিকা গ্রহণই পারে আমাদের এবং আমাদের সমাজকে এই নতুন ঢেউ থেকে রক্ষা করতে। আসুন, আমরা সকলে মিলে এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় সচেষ্ট হই।
লেখক – এসকে হেলাল, কবি ও কলাম লেখক।