আনোয়ার সাঈদ তিতু, কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি:-
পানি, বিদ্যুৎ, রাস্তাঘাট, যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ বসবাসের জন্য সব ধরনের সুবিধা থাকলেও আশ্রয়ণ প্রকল্পে থাকছেন না বাসিন্দারা। প্রকাশ্যে ও গোপনে আশ্রয়ণের ঘর বিক্রি করে দিচ্ছেন সুবিধাভোগীরা। এ চিত্র কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলার মুন্সিবাড়ী আশ্রয়ণ প্রকল্পের।
অনিয়ম-দুর্নীতি ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের তদারকির অভাবে মুন্সিবাড়ী আশ্রয়ণ প্রকল্পের শুরু থেকেই ছিলেন না অর্ধশত সুবিধাভোগী। তারা প্রকাশ্য ও গোপনে অন্তত ২৫টি বসতঘর বিক্রি করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
উপজেলা ভূমি অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছরে আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর অধীনে মুন্সিবাড়ী আশ্রয়ণ প্রকল্পে দুই দফায় ১২১টি ঘর নির্মাণ করা হয়। প্রতিটি ঘর নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় ২ লাখ টাকা। প্রতিটি বাড়িতে দুটি শয়ন কক্ষ, রান্নাঘর, শৌচাগারসহ বারান্দা রয়েছে। রয়েছে বিদ্যুৎ, সুপেয় পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা। ২ শতক জমিসহ ওই বছরে সুবিধাভোগীদের নামে দলিলমূলে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। বর্তমানে ১২১টি ঘরের মধ্যে ৬০টি ঘরে কেউ থাকেন না। বিক্রির উদ্দেশ্যে শুরু থেকেই এসব ঘর তালা দিয়ে দখলে রাখা হয়েছে বলে বাসিন্দাদের অভিযোগ।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের সরকারি বন্দোবস্তের শর্ত ভঙ্গ করায় ২০২২ সালে ইউএনও অফিস থেকে ৬ জনকে নোটিশ দেওয়া হয়। ২০২৪ সালে ১৭ এপ্রিল ‘অধিকাংশ ঘরে ঝুলছে তালা’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের নির্দেশে তদন্ত করে সত্যতা পান সহকারী কমিশনার (ভূমি)। পরে তারা মুচলেকা দিয়ে রক্ষা পান। তারপরও অবস্থার উন্নতি তো দূরের কথা, আরও অবনতি হয়েছে।
গত সোম ও মঙ্গলবার সরেজমিন মুন্সিবাড়ী আশ্রয়ণ প্রকল্পে গিয়ে দেখা যায়, অধিকাংশ ঘরে কেউ বসবাস করছেন না। ঘরের দরজায় তালা ঝুলছে। কিছু বসতঘরের সামনে টিন ও বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরাও দিয়ে দখলে রেখেছেন সুবিধাভোগীরা। ঝোপ-ঝাড়ে ভরে গেছে প্রকল্প এলাকা।
আশ্রয়ণের বাসিন্দা নুর আক্তার, মরিয়ম বেগম, শামছুন্নাহার, ছকিনা বেওয়া ও মমেনা বেগম বলেন, আশ্রয়ণের ৩ নম্বর ব্লকের সুবিধাভোগী রেবেকা বেগম (ঘর নম্বর ৫১), মালেকা বেগম (ঘর নম্বর ৪৫), সাহাবুদ্দিন (ঘর নম্বর ৪), মাহমুদুল্লা (ঘর নম্বর ৩৩), শিমুল মেহেদী (ঘর নম্বর ১৪), আইরিন বেগম (ঘর নম্বর ৫৯), আকবর আলী (ঘর নম্বর ৬১), বদিউজ্জামান (ঘর নম্বর ৪৬), নাজমুল হোসেন (ঘর নম্বর ৪৩) এবং ২ নম্বর ব্লকের মাজেদা বেগম, ফজলু মিয়াসহ অনেকই ঘর বিক্রি করেছেন।
অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, আশ্রয়ণের ৩টি ব্লকে ১২১টি ঘরের মধ্যে ১৫টি ঘর ইতোমধ্যে প্রকাশ্যে বিক্রি হয়েছে। ১০টি ঘর বিক্রির চেষ্টা চলছে। স্থায়ীভাবে সেখানে বসবাস করছেন মাত্র ৪০ জন সুবিধাভোগী। মাঝে মধ্যে আসেন ১০ জন। প্রকল্পের ঘর কিনে বসবাস করছেন ১১ জন। ৬০টি ঘরে কেউ থাকেন না। এসব ঘরের মালিককে কেউ কোনো দিন দেখেননি বলে জানান বাসিন্দারা।
আশ্রয়ণের ৩৩ নম্বর ঘর ২০ হাজার টাকায় কিনেছেন বলে জানান আলমগীর হোসেন নামে এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, ‘নিজের বাড়ি ঘর নাই, অন্যের বাড়িতে ছিলাম, ধার-দেনা করে ঘরটি কিনে পরিবার নিয়ে বসবাস করছি। সরকার যদি বের করে দেয়, তাহলে অন্য কোথাও মাথা গোঁজার উপায় নাই।’ আলমগীরের মতো একই কথা বলেন আশ্রয়ণের ঘর কিনে নেওয়া আমিনা বেগম, মমিনুল ইসলাম, গাজী মিয়া, আশরাফুল ইসলাম, এজাজ আলী ও মমতাজ।
৪৬ নম্বর ঘরে বসবাসকারী এজাজুল হক বলেন, ঘরটি আব্দুল হাকিম গ্রামের বদিউজ্জামানের নামের এক ব্যক্তির নামে বরাদ্দ ছিল। তাঁর কাছ থেকে কিনে নেন মারুফ হোসেন। পরে মারুফের কাছ থেকে ঘর কিনে তিনি সপরিবার বসবাস করছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা মো. একাব্বর হোসেন বলেন, যাদের ঘরবাড়ি আছে, তারা টাকা পয়সা দিয়ে কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে আশ্রয়ণের ঘরগুলো বরাদ্দ নিয়েছেন। এখন তারা ঘরগুলো বিক্রি করে দিচ্ছেন। প্রকৃত বাড়িভিটা নেই এমন ব্যক্তিরা ঘর পাননি। এমন যারা পেয়েছেন তারা স্থায়ীভাবে সেখানে বসবাস করছেন।
ধরনীবাড়ী উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তা মন্টু কুমার সরকার বলেন, আশ্রয়ণের ঘরগুলো বিক্রি ঠেকানো যাচ্ছে না। বিষয়টি তিনি কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন।
উলিপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নয়ন কুমার সাহা বলেন, এ বিষয়ে কিছু জানেন না তিনি। নিয়ম অনুযায়ী আশ্রয়ণের ঘর বিক্রি করা যায় না। এ বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।