স্টাফ রিপোর্টার:
দক্ষিণ চট্টগ্রামের পটিয়া-চন্দনাইশের পাহাড়জুড়ে শুধু পেয়ারা আর পেয়ারা। এ পেয়ারার কদর দেশ ও বিদেশে রয়েছে। প্রতিদিন শত শত টন পেয়ারা উৎপাদন করার পরও আরো তিন ভাগের দুই ভাগ পেয়ারা বাগানেই নষ্ট হচ্ছে শুধুমাত্র হিমাগারের অভাবে। এ নিয়ে স্থানীয় পেয়ারাচাষিদের মাঝে হতাশা বিরাজ করছে।
সূত্র জানায়, হিমাগার না থাকায় বাগানেই বেশিরভাগ পেয়ারা নষ্ট হচ্ছে। যদি উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে পাহাড়ের পেয়ারাগুলো সংরক্ষণ বা জুস ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলা যায়, তাহলে এ অঞ্চলের পেয়ারার কদর যেমন বাড়বে তেমনি পেয়ারা চাষিদের ভাগ্য ও পরিবর্তন হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু সরকারের যথাযথ উদ্যোগ ও পরিকল্পনার অভাবে বিদেশে পেয়ারার জুস রপ্তানির অবারিত সম্ভাবনাকে কাজে না লাগানোর ফলে এ সম্ভাবনাময় শিল্পটি দিনে দিনে মুখ থুবড়ে পড়েছে।
জানা যায়, পটিয়া-চন্দনাইশের উৎপাদিত পেয়ারা পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ।
পটিয়ার কেলিশহরের কাজী পেয়ারা ও কাঞ্চননগরের পেয়ারা এখন পুরোধমে বাজারে। এই পেয়ারা একটানা পাওয়া যাবে অক্টোবরের শেষে পর্যন্ত।
পেয়ারা চাষিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, পেয়ারার বাম্পার ফলন হলেও সম্প্রতি টানা বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পেয়ারা চাষিরা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ না ঘটলে তারা এবার অনেক লাভবান হতো বলে জানিয়েছেন।
পটিয়া-চট্টগ্রাম আরকান মহাসড়কের কমল মুন্সির হাট, বাদামতল, রওশন হাট, খাঁন হাট, কলেজ গেইট, বাগিচা হাট, দোহাজারী, খান হাট রেল স্টেশন, কেলিশহর, পটিয়া রেল স্টেশন, পেয়ারার বাজার ঘুরে দেখা যায়, লাল সালু কাপড়ে মোড়ানো ও কাঁধে করে আনা ভারে ভারে পেয়ারার পসরা সাজিয়ে বসে আছেন বিক্রেতারা। আর সেই লাল সালু কাপড়ের মোড়ানো ব্যাগের পেয়ারা বিক্রি হচ্ছে ৬০০-৮০০ টাকায়।
পেয়ারাচাষিরা আরো জানান, যারা আগাম লাখ লাখ টাকা দাদন নিয়ে বাগান কিনেছে তাদের মাঝে সবসময় ভয় বিরাজমান। কখন কী হবে। গহীন অরণ্য থেকে পেয়ারা বাজার পর্যন্ত আনতে প্রতি ভারে শ্রমিকদের ধোলাই খরচ দিতে হয় ২০০-৩০০ টাকা।
তাই এবার পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলেও সৃষ্ট প্রাকৃতিক বন্যা আর পাহাড়ি ঢলে লাভবানের চেয়ে ক্ষতির সম্ভাবনা বেশি।
চাষিরা জানান, সরকারিভাবে এলাকার উৎপাদিত পেয়ারা সংরক্ষণের জন্য হিমাগার থাকলে আমাদের আর্থ সামাজিক অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন হয়ে যেতো। সারা বছরজুড়ে আমরা তা সংরক্ষণ করে বাজারে বিক্রি করতে পারতাম।
এদিকে, দক্ষিণ চট্টগ্রামের পটিয়া-চন্দনাইশের পাহাড়ে দুই জাতের পেয়ারা রয়েছে। একটি কাজি পেয়ার অন্যটি কাঞ্চননগর পেয়ারা নামে বেশ পরিচিত। কাজি পেয়ারা আকারে বড় হলে ও স্বাদ একটু কম, আর কাঞ্চননগরের পেয়ারা সাইজে ছোট হলেও স্বাদ এবং পুষ্টিতে ভরপুর। দক্ষিণ চট্টগ্রামের পটিয়া-চন্দনাইশের কাঞ্চন নগরের পেয়ারার মূল উৎপাদনস্থল।
পেয়ারা চাষ করে বদলে গেছে এখানকার হাজারও চাষির ভাগ্য। দুই উপজেলার পটিয়ার কেলিশহর, হাইদগাও, চন্দনাইশের কাঞ্চননগর থেকে দোহাজারী, কাঞ্চন নগর, হাসিমপুর ও জামিজুরী ইউনিয়নের প্রায় ৬০ থেকে ৭০ ভাগ মানুষ পেয়ারা চাষ করে থাকে।
স্থানীয়ভাবে পেয়ারাকে কেউ গয়ামথ, কেউবা গোয়াছিথ বলেন। বাংলার আপেল হিসেবে খ্যাত ভিটামিন সি সমৃদ্ধ সুস্বাদু পেয়ারার একটি উন্নত জাত কাজি পেয়ারা। খেতে মিষ্টি ও দেখতে সুন্দর বলে এই পেয়ারার চাহিদাও বেশি, যা পটিয়া ও চন্দনাইশের পাহাড়ি উর্বর জমিতে প্রচুর উৎপন্ন হচ্ছে।
কাঞ্চন নগর এলাকার পেয়ারাচাষি শামশুল আলম বলেন, চন্দনাইশে পাহাড়ের কোলঘেঁষে প্রায় পাঁচ হাজারের অধিক পেয়ারা বাগান রয়েছে। পাহাড়ের অধিকাংশ জমি অনাবাদী ছিল, কিছু জমিতে হতো জুমচাষ। বিগত দুই দশক ধরে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এসব অঞ্চলের পেয়ারা চাষ। ফলন ও চারা রোপণের পর তেমন খরচ না থাকা এবং লাভজনক হওয়ায় অনেকেই এখন এ চাষের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। মূলত বন বিভাগের মালিকানাধীন পাহাড়ি জমি লিজ নিয়ে পেয়ারা চাষ করা হচ্ছে। আবার অনেকের কেনা জায়গায় ও পেয়ারা চাষ করছেন।
জানা যায়, যে বাগান মালিক পাহাড় একবার লিজ পেয়েছে সে প্রতিবছর ওই পাহাড়ের লিজ নবায়ন করে পেয়ারার চাষ করে আসছে। বার্ষিক খাজনা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, রক্ষণাবেক্ষণ করার সব দায়িত্ব চাষিদের হাতেই। তাই তারা পেয়ারার অধিক ফলনে সচেষ্ট থাকে এবং প্রতিবছর চাহিদামতো ফলনও পাচ্ছেন। বছরের চৈত্র-বৈশাখ মাসে গাছে ফুল আসে। জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্র মাস পর্যন্ত বাগান থেকে পেয়ারা সংগ্রহ করা হয়। এ অঞ্চলের পেয়ারাগুলো ওজনে এক কেজি ও সর্বনিম্ন ২৫ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে। একেকটি গাছ থেকে ৮০০-১০০০টি পেয়ারা পাওয়া যায়। এক ভার পেয়ারা বিক্রি করা হয় দুই হাজার টাকা থেকে আড়াই হাজার টাকা পর্যন্ত।
পটিয়ার বাগান মালিক আকবর উদ্দিন বলেন, পেয়ারা চাষ করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার পাশাপাশি এখানে কর্মসংস্থান হয়েছে হাজারও মানুষের। তবে দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল থেকে প্রতিদিন পেয়ারা সংগ্রহ করে বাজারজাতকরণে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। পেয়ারা সংরক্ষণের জন্য এ অঞ্চলে কোনো হিমাগার নেই। হিমাগার থাকলে লাখ লাখ টাকার পেয়ারা নষ্ট হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেতো।
পটিয়া-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার আরকান মহাসড়কের পটিয়া থেকে চন্দনাইশের সাত-আট জায়গায় প্রতিদিন ভোর থেকে বসে পেয়ারার হাট। দক্ষিণ চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় পেয়ারার হাট বসে চন্দনাইশের রৌশন হাটে। মহাসড়কের দুইপাশে লাল কাপড় বাঁধা পেয়ারার সারি সারি ভার নিয়ে বসে থাকেন বিক্রেতারা। ব্যবসায়ীদের হিসেব মতে, প্রতিদিন ৫০০ ভার পেয়ারা বিক্রি হয় এ বাজারে। এখানকার পেয়ারা রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, পেকুয়া, চকরিয়া, টেকনাফ, হাটহাজারী, বাঁশখালী, লোহাগাড়া, নোয়াখালী, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় নিয়ে যান ব্যবসায়ীরা। পেয়ারা বিক্রি চলে অক্টোবর মাস পর্যন্ত। চারা রোপণ থেকে শুরু করে ফল আহরণ পর্যন্ত তেমন একটা রাসায়নিক সার কিংবা কীটনাশক ব্যবহার করা হয় না বলে জানান চাষিরা।
পটিয়া কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, পটিয়ার গহীন অরণ্যে দুই-তিনশ পেয়ারার বাগান গড়ে উঠেছে। তাছাড়া পার্শ্ববর্তী চন্দনাইশ, সাতকানিয়া ও বাঁশখালীতে পেয়ারার চাষ হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব, আরব-আমিরাতসহ আরো কয়েকটি দেশে পেয়ারা রপ্তানি করছেন। পেয়ারা চাষিদের বেশ কিছু সমস্যা ও রয়েছে বলে ব্যবসায়ীরা। তার মধ্যে পেয়ারা বিক্রির জন্য কোনো নির্দিষ্ট স্থান নেই। নেই পেয়ারা সংরক্ষণের জন্য সুব্যবস্থা। এছাড়াও পেয়ারা চাষিরা আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে নামমাত্র মূল্যে আগাম সুবিধাভোগীদের মাঝে পেয়ারা বিক্রি করেন বাধ্য হয়ে। চাষিরা সরকারি-বেসরকারিভাবে পর্যাপ্ত সুবিধা পেলে পাল্টে দিতে পারেন অর্থনীতির চাকা। এ জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু নীতিমালা ও তার বাস্তবায়ন। পেয়ারা চাষিদের সহজশর্তে ঝণ প্রদান, পেয়ারা সংরক্ষণের জন্য হিমাগার স্থাপন।