অনলাইন ডেস্ক:
রাশিয়ার ভাড়াটে সেনাদল ওয়াগনার গ্রুপ দেশটির সামরিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে বলে খবর দিয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম। রুশ অভিজাত ব্যবসায়ী ইয়েভগেনি প্রিগোঝিনের নেতৃত্বাধীন এই বাহিনী রাশিয়ার হয়ে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিল। তবে সেখান থেকে ঘুরে মস্কোর দিয়ে যাত্রা শুরু করলে ক্রেমলিন একে ‘বিদ্রোহ’ আখ্যা দেয়। ফলে খোদ রাশিয়ায় গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দেয়। পরে শনিবার সন্ধ্যায় প্রিগোঝিন বাহিনীর অগ্রযাত্রা থামাতে সম্মত হন। এদিকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এ ঘটনাকে রাশিয়ার ‘পূর্ণমাত্রার দুর্বলতার প্রতিফলন’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। রয়টার্স, আল জাজিরা, দ্য গার্ডিয়ান, বিবিসি।
দৃশ্যত যুদ্ধের মনোভাবে মস্কো অভিমুখে রওনা দেয় রাশিয়ার ভাড়াটে সেনাদল ওয়াগনার গ্রুপ। ইউক্রেনে রাশিয়ার নিয়মিত বাহিনীর পাশাপাশি যুদ্ধ করা এই বাহিনী গত শুক্রবার রাত থেকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে রাশিয়ায় প্রবেশ শুরু করে। শনিবার দুপুরে ওয়াগনারের সেনারা দুটি বড় শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে বলে দাবি করা হয়। এই তৎপরতাকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ ও ‘পেছন থেকে ছুরিকাঘাত’ আখ্যা দিয়ে দমনের হুশিয়ারি দিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন। তবে ওয়াগনার প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোঝিন বলেছেন, বিশ্বাসঘাতকতা বলে পুতিন ভুল করেছেন। এদিকে রাশিয়ার পরিস্থিতির ওপর নজর রাখার কথা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি পশ্চিমা দেশ।
শনিবার রাতে বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কোর কার্যালয় জানায়, ওয়াগনার বাহিনীর প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোঝিন রুশ ভূখণ্ডে তার সেনাদের অগ্রযাত্রা থামাতে এবং উত্তেজনা প্রশমনের প্রস্তাবে রাজি হয়েছেন। রাশিয়ার সংবাদমাধ্যমেও একই ধরনের খবর প্রকাশ করা হয়েছে।
বেলারুশ প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, শনিবার সকালে পরিস্থিতি সম্পর্কে লুকাশেঙ্কোকে অবহিত করেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তার অনুমোদনে লুকাশেঙ্কো দিনভর প্রিগোঝিনের সঙ্গে আলোচনা করেন।
ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সারা দিন আলোচনা চলে। এর ফলাফল হিসেবে তারা রাশিয়ার ভূখণ্ডে রক্তক্ষয়ী হত্যাযজ্ঞের অগ্রহণযোগ্যতা নিয়ে চুক্তিতে পৌঁছেছেন।
বেলারুশের প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ের বিবৃতি প্রকাশের কিছুক্ষণের মধ্যে নিজের টেলিগ্রাম চ্যানেলে অডিওবার্তা প্রকাশ করেন ওয়াগনারপ্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোঝিন। তিনি জানান, মস্কো অভিমুখে যেতে থাকা সেনাদের থেমে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘যাত্রা শুরুর প্রথম দিনে মস্কোর ২০০ কিলোমিটারের মধ্যে পৌঁছে গেলেও আমাদের যোদ্ধাদের এক ফোঁটা রক্তও ঝরেনি। কিন্তু এখন ঝরতে পারে।’ সেই কারণে এই সিদ্ধান্তের কথা জানান তিনি।
ইউক্রেনে যুদ্ধ কীভাবে পরিচালিত হবে তা নিয়ে রুশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে গত কয়েক মাস থেকে ওয়াগনার বাহিনীর উত্তেজনা বাড়ছিল। গত কয়েক মাসে বেশ কয়েকবার রাশিয়ার সামরিক নেতৃত্বের প্রকাশ্য সমালোচনা করেন প্রিগোঝিন।
এদিকে, মস্কো অভিমুখে রওনা দেওয়ার পরও অভ্যুত্থানের কথা অস্বীকার করেছেন ইয়েভগেনি প্রিগোঝিন। ক্রেমলিন প্রিগোঝিনকে সশস্ত্র বিদ্রোহে অভিযুক্ত করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে রাশিয়ায় প্রবেশ শুরু করে ওয়াগনার বাহিনী। প্রিগোঝিন জানান, তার বাহিনী ইউক্রেন সীমান্তবর্তী রুশ শহর রোস্তভ-অন-দনের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। শহরটির বাসিন্দাদের ঘরে থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে। বিবিসি জানিয়েছে, ওয়াগনার বাহিনীর সেনারা ভরোনেঝ শহরের সামরিক স্থাপনার নিয়ন্ত্রণও নিয়েছে। এই শহরটি রোস্তভ-অন-দন থেকে মস্কো যাওয়ার রাস্তার মাঝখানে পড়ে। শনিবার দুপুরে রাশিয়ার আর এক শহর লিপেৎস্কের দখল নিয়েছে তারা। মস্কো থেকে ওই শহর মাত্র ছয় ঘণ্টার পথ।
রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সেগেই শোইগুর সাক্ষাৎ না পেলে মস্কো পর্যন্ত চলে যাওয়ার হুমকি দেন ওয়াগনার প্রধান প্রিগোঝিন। যুক্তরাজ্য জানিয়েছে, ওয়াগনার সেনারা রাজধানী মস্কো অভিমুখে এগিয়ে যাচ্ছে। এদিকে, শুক্রবার রাত থেকেই রাশিয়ায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। মস্কোর রাস্তায় সামরিক ট্রাক চলাচল করতে দেখা গেছে। দেশটিতে ইন্টারনেট সেবা সীমিত রাখা হয়েছে।
রোস্তভ-অন-দন শহরে প্রবেশের পর ওয়াগনার প্রধান প্রিগোঝিন বলেন, সামনে কেউ দাঁড়ালে তাদের ধ্বংস করে দেবে তার সেনারা। রাশিয়ার একটি সামরিক হেলিকপ্টার ভূপাতিত করার দাবি করেন তিনি। তবে কোথায় এই ঘটনা ঘটেছে তা জানাননি। তার বর্ণনাও তাৎক্ষণিকভাবে যাচাই করা যায়নি।
গত শুক্রবার ৬২ বছরের প্রিগোঝিন অভিযোগ করেন, তার বাহিনীর ওপর প্রাণঘাতী ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে রুশ বাহিনী। তিনি এই হামলায় জড়িতদের শাস্তির শপথ নেন। সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম টেলিগ্রামে পোস্ট করা এক অডিওবার্তায় ওয়াগনার প্রধান বলেন, রাশিয়ার সামরিক নেতৃত্বের ‘দানবদের’ থামাতে হবে। তিনি বলেন, ‘যারা আমাদের সেনা হত্যা করেছে এবং (ইউক্রেন যুদ্ধে) রাশিয়ার হাজার হাজার সেনা হত্যা করেছে, তাদের শাস্তি দেওয়া হবে। আমি আপনাদের বলব প্রতিরোধ করবেন না। যারা করবে তাদের হুমকি বিবেচনা করা হবে এবং ধ্বংস করা হবে। এটা কোনো সামরিক অভ্যুত্থান নয়, বিচারের জন্য যাত্রা। আমাদের কর্মকাণ্ড সেনাবাহিনীর পথে বাধা হবে না।’
পরিস্থিতি বিবেচনায় শনিবার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে ভাষণ দেন প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন। এতে তিনি বলেন, ওয়াগনার প্রধান এক সশস্ত্র বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। পুতিন বলেন, রাশিয়া নিজের ভবিষ্যতের জন্য সবচেয়ে কঠিন লড়াই চালাচ্ছে। তিনি বলেন, রুশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যারাই অস্ত্র তুলে নেবে তাদের শাস্তি পেতে হবে। পরিস্থিতি শান্ত করতে প্রয়োজনীয় আদেশ দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
টেলিভিশনে পুতিনের ভাষণ প্রচারের পর ওয়াগনার প্রধান প্রথমবারের মতো সরাসরি পুতিনের সমালোচনা করেছেন। এক অডিওবার্তায় তাকে বলতে শোনা যায়, বিশ^াসঘাতক আখ্যা দিয়ে পুতিন গভীর ভুল করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা দেশপ্রেমিক আর যারা আমাদের বিরুদ্ধে, তারা বাজে লোকদের পাশে জড়ো হয়েছে।’ এর আগে শনিবার রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ রুশ নাগরিকদের পুতিনের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।
এদিকে, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, কোনো মিথ্যা দিয়েই রাশিয়ার বিশৃঙ্খলা গোপন করা যাবে না, আর সশস্ত্র বিদ্রোহ দেশটির পূর্ণমাত্রার দুর্বলতার প্রতিফলন। এক টুইট বার্তায় জেলেনস্কি লেখেন, রাশিয়ার দানব ও বিশৃঙ্খলা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে সক্ষম ইউক্রেন। আমরা আমাদের প্রতিরোধ, ঐক্য এবং শক্তি বজায় রাখব।
এদিকে, রাশিয়ার পরিস্থিতি নিয়ে শনিবার ফ্রান্স, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। হোয়াইট হাউসের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট বাইডেন আজ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাঁক্রন, জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শ্যুলজ এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের সঙ্গে কথা বলেছেন। নেতারা রাশিয়ার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। এ ছাড়াও তারা ইউক্রেনের প্রতি অটুট সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন।
পুতিনের অবস্থান নিয়ে সংশয়
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের উড়োজাহাজ মস্কোর ভুনুকু বিমানবন্দর থেকে স্থানীয় সময় দুপুর ২টা ১৬ মিনিটে উড়াল দিয়েছে বলে একাধিক খবর প্রচার হয়েছে। উড়োজাহাজটি উত্তর-পশ্চিম দিকে গেছে বলেও জানা গেছে। বিমান ট্র্যাকিং ওয়েবসাইট ফ্লাইটরাডার জানাচ্ছে, উড়োজাহাজটি মস্কো থেকে প্রায় ১১০ মাইল দূরে তেভার এলাকায় পৌঁছেছে। ওই এলাকায় পুতিনের একটি বাসভবন রয়েছে। তবে ওই উড়োজাহাজে পুতিন ছিলেন কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তার মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ একটি বার্তা সংস্থাকে বলেছেন, পুতিন ক্রেমলিনে কাজ করছেন।
এদিকে, ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রকে উদ্ধৃত করে শনিবার জানিয়েছে, রাশিয়ায় আইনের শাসনের প্রতি সমর্থন রাখে ইরান। আর রাশিয়ার বর্তমান ঘটনাপ্রবাহ দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয়।