বিনোদন ডেস্ক:
ভারতীয়-বাঙালি চলচ্চিত্রাভিনেতা, চিত্রপ্রযোজক, পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, সংগীত পরিচালক ও গায়ক উত্তম কুমারের প্রয়াণ দিবস আজ। ১৯৮০ সালের এই দিনে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান তিনি।
ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও জাত অভিনেতা উত্তম কুমারের আসল নাম অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায়। তিনি ১৯২৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর কলকাতার ভবানীপুরে ৫১ আহিড়ীটোলা স্ট্রীটে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার ছোট ভাই তরুণ কুমার ছিলেন বাংলা সিনেমার এক জনপ্রিয় অভিনেতা। তার বাবা ছিলেন কলকাতার মেট্রো সিনেমা হলের এক সাধারণ কর্মচারী।
প্রথমে চক্রবেড়ীয়া হাই স্কুলে ভর্তি হন উত্তম কুমার। এবং পরে সাউথ সাবার্বান স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। ৫ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা মুকুট নাটকে অভিনয় করে তুমুল প্রশংসিত হন এবং একটি সোনার পদক যেতেন।
১৪ বছর বয়সে গয়াসুর নাটকে অভিনয় করেও পুরস্কৃত হন। ১৯৪৫ সালে কলকাতার গোয়েঙ্কা কলেজে অব কমার্সে ভর্তি হন। পারিবারিক আর্থিক অনটনের জন্য কলকাতার পোর্টে চাকরি নিয়ে কর্মজীবন শুরু করলেও গ্র্যাজুয়েশন শেষ করতে পারেননি। ছেলেবেলা থেকেই খেলাধুলা ও অভিনয় পাগল ছিলেন। বাড়ির বড়দের থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে সিনেমা দেখা, নাটক দেখা ছিল তার নেশা।
কলকাতা বন্দরে কেরানির চাকরিতে মাসিক ২৭৫ টাকা মাইনে দিয়ে কর্মজীবন শুরু হয় তার। তবে চাকরি করলেও অভিনয় থেকে বিরত থাকতে পারেননি। রীতিমতো থিয়েটার করতেন এবং টালিগঞ্জের স্টুডিও পাড়ায় ঘোরাফেরা করতেন সিনেমায় সুযোগের জন্য। সেকারণে অনেকবার তাকে চাকরি কামাই করতে হয়েছে।
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার বছরে উত্তম কুমার তার এক বন্ধুর সহযোগিতায় প্রথম ‘মায়াডোর’ নামে একটি হিন্দি চলচ্চিত্রে কাজের সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য জীবনের প্রথম ছবিই মুক্তিলাভ করেনি তার। উত্তম কুমারের প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ছিল তার ঠিক পরের বছর ১৯৪৮ সালের ‘দৃষ্টিদান’ ছবি।
তবে সাফল্য আসে নির্মল দের পরিচালনায় ‘বসু পরিবার’ চলচ্চিত্রে। এরপর অসংখ্য ব্যবসাসফল সিনেমা উপহার দিয়েছেন তিনি। তাকে বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল ও সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিনেতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ক্যারিয়ার জুড়ে অসংখ্য বাণিজ্যিক সাফল্যের পাশাপাশি সমালোচকদেরও তুমুল প্রশংসা কুড়িয়েছেন তিনি।
তার উল্লেখযোগ্য সিনেমা-‘দৃষ্টিদান’, ‘সাড়ে চুয়াত্তর’, ‘চিড়িয়াখানা’, ‘এন্টনী ফিরিঙ্গী’, ‘নায়ক’, ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘স্ত্রী’, ‘অমানুষ’, ‘অগ্নীশ্বর’, ‘সন্ন্যাসী রাজা’, ‘গৃহপ্রবেশ’, ‘কামনা’, ‘মর্যাদা’, ‘সহযাত্রী’, ‘ওরে যাত্রী’, ‘সঞ্জীবনী’, ‘শাপ মোচন’, ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’, ‘তাসের ঘর’, ‘যাত্রা হলো শুরু’, ‘হারজিৎ’, ‘সুরের পরশে’, ‘পুনর্মিলন’, ‘পৃথিবী আমারে চায়’, ‘বড়দিদি’, ‘দেবদাস’, ‘দুই পুরুষ’, ‘গৃহদাহ’ ইত্যাদি।
‘সাড়ে চুয়াত্তর’ সিনেমাতে তিনি প্রথম অভিনেত্রী সুচিত্রা সেনের বিপরীতে অভিনয় করেন। এই সিনেমার মাধ্যমে বাংলা চলচ্চিত্র জগতের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং সফল উত্তম-সুচিত্রা জুটির সূত্রপাত হয়। উত্তমকুমার এবং সুচিত্রা সেন বাংলা চলচ্চিত্রে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে অনেকগুলো ব্যবসায়িকভাবে সফল এবং একই সঙ্গে প্রশংসিত চলচ্চিত্রে মুখ্য ভূমিকায় একসঙ্গে অভিনয় করেছিলেন। এগুলোর মধ্যে প্রধান হলো- ‘হারানো সুর’, ‘পথে হল দেরি’, ‘সপ্তপদী’, ‘চাওয়া পাওয়া’, ‘বিপাশা’, ‘জীবন তৃষ্ণা’ এবং ‘সাগরিকা’।
উত্তম কুমার বেশ কয়েকটি হিন্দি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছিলেন। তার অভিনীত হিন্দি চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে- ‘ছোটিসি মুলাকাত’, ‘অমানুষ’ এবং ‘আনন্দ আশ্রম’ অন্যতম।
তিনি ৫ বার জাতীয় পুরস্কার, ৮ বার বিএফজেএ পুরস্কার ও ৩ বার ফিল্মফেয়ার পুরস্কার, প্রসাদ পত্রিকা পুরস্কার, সাংস্কৃতিক সাংবাদিক সংস্থা পুরস্কার, চলচ্চিত্র প্রসার সমিতি পুরস্কার লাভ করেন। ভারত সরকার ১৯৭৫ সালে তাকে মহানায়ক উপাধি দেয়।
১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই ‘ওগো বধূ সুন্দরী’ সিনেমায় শুটিংরত অবস্থায় হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হন উত্তম কুমার। ওইদিন রাত সাড়ে ৯টায় কলকাতার বেলভিউ ক্লিনিকে ভুবনভোলানো হাসিমাখা এই মহান অভিনেতা সবাইকে কাঁদিয়ে পরপারে পাড়ি জমান।