ছয়টি সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনে জাতীয় পার্টির (জাপা) সঙ্গে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের কোনো সমঝোতা হচ্ছে না; বরং জাপার ভালো করার সম্ভাবনা আছে, এমন তিনটি আসনের মধ্যে দুটি আসন ১৪-দলীয় জোটের শরিকদের ছেড়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। একটি আসন উন্মুক্ত রেখেছে, আর তিনটি আসনে প্রার্থী দিয়েছে দলটি। যদিও ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সমঝোতার ভিত্তিতেই ভোটে অংশ নেয় আওয়ামী লীগ ও জাপা। পরে জাপা জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল হয় দলীয় সূত্র বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে জাপার শীর্ষ নেতৃত্বের সরকারবিরোধী ভূমিকা ভালোভাবে নেননি আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরা। আসন্ন উপনির্বাচনে জাপাকে কোনো ছাড় না দেওয়ায় তা আরও স্পষ্ট হলো। এ ছাড়া নানা কারণে জাপার শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে সরকারের একধরনের দূরত্বও তৈরি হয়েছে।
গত ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে গণভবনে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে জাপার প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ ও চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের সাক্ষাতের পর গুঞ্জন ছড়ায়, বিএনপির ছেড়ে দেওয়া ছয়টি আসনের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ খুব একটা আগ্রহী নয়।
জাপাকে কয়েকটি আসন ছেড়ে দেবে আওয়ামী লীগ, এমন আলোচনাও তখন শোনা যায়। কিন্তু এখন পর্যন্ত সে রকম কিছু দৃশ্যমান নয়। আগামী ১ ফেব্রুয়ারি এসব আসনে উপনির্বাচনে ভোট গ্রহণ করা হবে।
ছয়টি সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনে জাপার সঙ্গে কোনো সমঝোতায় না এলেও রাশেদ খান মেননের বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ও হাসানুল হক ইনুর বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা করেছে আওয়ামী লীগ। তাদের দুটি আসন ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনটি উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। বিএনপি থেকে পদত্যাগ করে এই আসনে প্রার্থী হয়েছেন উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া। উপনির্বাচন নিয়েও ক্ষমতাসীন দলের নানামুখী কৌশল কী বার্তা দিচ্ছে, তা নিয়ে জাপায় আলোচনা আছে।
জাপার কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, ঠাকুরগাঁও-৩, বগুড়া-৬, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের উপনির্বাচনে ভালো করার ব্যাপারে তাঁরা আশাবাদী ছিলেন। এই আসনগুলোতে যথাক্রমে হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, নুরুল ইসলাম ওমর, মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক ও রেজাউল ইসলাম
জাপার কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, ঠাকুরগাঁও-৩, বগুড়া-৬, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের উপনির্বাচনে ভালো করার ব্যাপারে তাঁরা আশাবাদী ছিলেন। এই আসনগুলোতে যথাক্রমে হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, নুরুল ইসলাম ওমর, মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক ও রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়াকে প্রার্থী করা হয়। কিন্তু ঠাকুরগাঁও-৩ আসনটি ওয়ার্কার্স পার্টিকে এবং বগুড়া-৬ আসনটি জাসদকে ছেড়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। আর ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে দলীয় প্রার্থী না দিয়ে উন্মুক্ত রেখেছে তারা।
জাপার নেতারা জানান, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের ওপর তাঁদের বিশেষ দৃষ্টি রয়েছে। এর কারণ দুটি। প্রথমত, গত দুটি সংসদ নির্বাচনে এ আসনে জাপার মনোনয়ন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া ও জিয়াউল হক মৃধা। তাঁরা সম্পর্কে যথাক্রমে জামাই-শ্বশুর।
মনোনয়ন নিয়ে দুজনের মধ্যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব পরিবার পর্যন্ত গড়িয়েছে। দ্বিতীয়ত, জিয়াউল হক মৃধা জাপা থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর তিনি দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের বিরুদ্ধে মামলা করেন। সে মামলায় আদালতের নিষেধাজ্ঞায় জি এম কাদের তিন মাস ধরে রাজনৈতিক কার্যক্রম থেকে বিরত রয়েছেন। ফলে আসনটির ওপর নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি দলের শীর্ষ নেতৃত্বেরও বিশেষ দৃষ্টি রয়েছে। কিন্তু এ আসনে আওয়ামী লীগের পাঁচজন মনোনয়নপত্র নিলেও কাউকে দলীয় প্রতীক দেওয়া হয়নি।
অন্যদিকে জাতীয় সংসদ থেকে সদ্য পদত্যাগী বিএনপির সংসদ সদস্য উকিল আবদুল সাত্তার এ আসনে আবারও প্রার্থী হয়েছেন। হঠাৎ করে তাঁর স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া এবং আসনটিতে নৌকার প্রার্থী না রাখার ঘটনায় জাপার নেতাদের সন্দেহ আর বাড়িয়ে দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে জাপার প্রার্থী রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত নেন।
রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘শ্বশুরও থামছেন না, মহাজোটও হয়নি। উকিল আবদুল সাত্তার একটা মিশন নিয়ে আসছেন, তাঁকে যে করে হোক এমপি (সংসদ সদস্য) বানানো হবে—এটা জানার পর আর আগ্রহ থাকল না।’
রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়ার পরিবর্তে গতকাল ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে মো. আবদুল হামিদ ভাসানীকে প্রার্থী ঘোষণা করেছে জাপা। একই সঙ্গে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনে মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনে মো. মোস্তাফিজুর রহমানকে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। এ দুটি আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী দিয়েছে। এর মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনে মো. জিয়াউর রহমান এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনে মো. আবদুল ওদুদকে প্রার্থী করা হয়েছে। আর বগুড়া-৬ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে রাগেবুল আহসানকে।
বিএনপির সংসদ সদস্য উকিল আবদুস সাত্তারের পদত্যাগে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২, জি এম সিরাজের পদত্যাগে বগুড়া-৬, হারুনুর রশিদের পদত্যাগে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩, আমিনুল ইসলামের পদত্যাগে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২, জাহিদুর রহমানের পদত্যাগে ঠাকুরগাঁও-৩, মোশাররফ হোসেনের পদত্যাগে বগুড়া-৪ ও রুমিন ফারহানার পদত্যাগে সংরক্ষিত নারী আসন ৫০ শূন্য হয়।
আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে জাপার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে জি এম কাদের ও রওশন এরশাদকে ঘিরে অভ্যন্তরীণ বিরোধের মধ্যে ছয়টি আসনে উপনির্বাচন হতে যাচ্ছে। এ নির্বাচনে জাপাকে এড়িয়ে চলা, জি এম কাদেরের ওপর আদালতের অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা এবং তাঁকে বিরোধীদলীয় নেতা করার
প্রস্তাব স্পিকারের কার্যালয়ে ঝুলে থাকা—একটির সঙ্গে আরেকটির কোনো যোগসূত্র আছে কি না, তা নিয়েও নানা আলোচনা আছে জাপার নেতা-কর্মীদের মধ্যে।
জাপার মহাসচিব মো. মুজিবুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘উপনির্বাচনের বিষয়ে কোনো সমঝোতা হয়নি। তারা (আওয়ামী লীগ) তাদের প্রার্থী দিয়েছে, আমরা আমাদের প্রার্থী দিয়েছি। আমরা সমঝোতা করতে যাইনি, প্রয়োজনও মনে করিনি। তবে জবরদখল যদি না হয়, নির্বাচন যদি সুষ্ঠু হয়, তাহলে আমরা অন্তত তিনটি আসনে ভালো করব।’